Advertisement

Main Ad

শস্যাবর্তন Crop Rotation

শস্যাবর্তন (Crop Rotation) :


অনেক সময় দেখা যায় একই জমি থেকে বার বার একই ফসল উৎপাদন করার ফলে জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায়। তখন সার প্রয়ােগ না করে সেই জমিতে বিভিন্ন বছরে বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করা হয়। এতে প্রাকৃতিকভাবে জমির উর্বরতা বজায় থাকে। যেমন, কোনাে জমিতে যদি একবছর গম চাষ করা হয়, তাহলে ওই জমিতে পরের বছর আলু বা বিট চাষ করা হয়, তার পরের বছর যব বা ওট, তার পরের বছর ডাল। কিংবা খরিফ শস্য ও রবিশস্য চাষের মধ্যবর্তী সময়ে মটর, ছােলা ইত্যাদি শুঁটি জাতীয় নাইট্রোজেন আবদ্ধকারী শস্যের চাষ করা হয়। 

সংজ্ঞা : - অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় থাকলে একই জমিতে বছরের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কিংবা এক এক বছরে পর্যায়ক্রমিকভাবে বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করাকে শস্যাবর্তন কৃষি পদ্ধতি বলে । 

শস্যাবর্তনের কারণ : - নিবিড় ও মিশ্র কৃষি ব্যবস্থায় শস্যাবর্তন পদ্ধতি প্রচলিত। নিবিড় কৃষিতে খাদ্যশস্যের অধিক উৎপাদনের জন্য বছরে একই জমিতে একটিমাত্র ফসলের একাধিক বার চাষ হয়। রাসায়নিক সার প্রয়ােগ করে ফলন বাড়ানাের ফলেই জমি দ্রুত অনুর্বর হয়ে পড়ে। তাই, প্রাকৃতিক উপায়ে ও জৈবিক প্রক্রিয়ায় মাটির স্বাভাবিক উর্বরতা বজায় রাখার জন্য ছয় মাস, এক বছর বা দু’বছর অন্তর উর্বরতা বৃদ্ধিকারী বিভিন্ন শস্য ফলানাে হয়।

শস্যাবর্তন পদ্ধতি অনুসরণের জন্য বিচার্য বিষয়গুলি : - শস্যাবর্তন পদ্ধতি অনুসরণের জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলিকে বিচার করা হয়।

১) মাটির গুণমান,  

২) মাটির আদ্রর্তা,  

৩) জলসেচের সুবিধা

 ৪) বীজ, কীটনাশক সার ইত্যাদির জোগান 

৫) সময়  

৬) উৎপন্ন ফসলের চাহিদা 

শস্যাবর্তনের ঝুঁকি : - শস্যাবর্তন প্রক্রিয়া অনুসরণ করার ক্ষেত্রে এই ঝুঁকিগুলি থেকেই যায়। যেমন— 

১) সঠিক পরিকল্পনামাফিক শস্যাবর্তন প্রক্রিয়া পরিচালনা না করলে মাটিতে পরিপােষকের অভাব ঘটতে পারে।  

২) জৈব সারের ব্যবহার কখনও কখনও শস্যের উৎপাদনশীলতা কমাতে পারে।  ৩) প্রযুক্তি, মূলধন ইত্যাদির সুবিধা না থাকলে প্রক্রিয়াটি লাভজনক হয় না

শস্যাবর্তনের গুরুত্ব বা উপকারিতা : - 

১) মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি : - মাটির তিনটি প্রধান পরিপােষক হল নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশ (NPK)। এই তিনটি উপাদান ভারসাম্য অবস্থায় থাকলে মাটির উর্বরতা বজায় থাকে। এর মধ্যে বেশি দরকার নাইট্রোজেন। এজন্য শস্যাবর্তনের মাধ্যমে মাটিতে নাইট্রোজেন আবদ্ধকারী উদ্ভিদ; যেমন— ভুট্টা, মটর ও সয়াবিন চাষ করলে মাটিতে প্রয়ােজনমতাে

নাইট্রোজেনের সংযােজন ঘটানাে সম্ভব। এবং এর ফলে মাটির স্বাভাবিক উর্বরতা বজায় থাকে।

২) রােগ নিয়ন্ত্রণ : - স্বাস্থ্যবান ও পরিপুষ্ট উদ্ভিদের রােগ প্রতিরােধ করার ক্ষমতা দুর্বল গাছ অপেক্ষা অনেক বেশি। সুতরাং, উদ্ভিদের রােগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় প্রথমেই দরকার মাটিতে ভারসাম্যপূর্ণ পরিপােষকের উপস্থিতি, যা প্রকৃত শস্যাবর্তনের দ্বারা সম্ভব।

৩) আগাছা ধ্বংসকরণ : - এর মাধ্যমে ক্ষেতের আগাছা ধ্বংস করা সম্ভব হয়।

৪) মাটির জৈব পদার্থ বৃদ্ধি : - একটি জটিল শস্যাবর্তনের (ভুট্টা, যব, ক্লোভার) জন্য মাটির জৈব কার্বনের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। কারণ শস্যাবর্তনের জন্য মাটিতে বেশি পরিমাণে গাছের শিকড় থেকে যায়। দেখা গেছে যে সার প্রয়ােগ সত্ত্বেও এক ফসলি জমিতে এভাবে কার্বনের পরিমাণ বাড়ে না

৫) নাইট্রোজেন সংযােজন : - শস্যাবর্তন পদ্ধতিতে ভুট্টা, মটর ও সয়াবীন চাষ করলে মাটিতে প্রয়ােজনমতাে নাইট্রোজেনের সংযােজন ঘটানাে সম্ভব।

৬) ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রণ : - শস্যাবর্তনের জন্য জমিতে একাধিক বার চাষ হয়। প্রত্যেক বারের চাষে গাছের শিকড়ের অংশ মাটিতে থেকে যায়। গাছের শিকড় পচে তৈরি হয় হিউমাস। হিউমাস থাকায় মাটির কণাগুলি দৃঢ়ভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে যায় ।মাটি সহজে ক্ষয় হতে পারে না।

৭) পশুখাদ্যের চাষ : - মানুষের খাদ্যের সাথে সাথে পশুখাদ্যেরও চাষ করা হয়।  

৮) চাষির আয় বৃদ্ধি : - শস্যাবর্তনের মাধ্যমে জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ে। ফলে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং সামগ্রিকভাবে চাষির আয় বাড়ে।


 শস্য সমন্বয় (Crop Combination) : -

জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতি, মাটির উর্বরতা ও ভৌত-রাসায়নিক ধর্মের ভিত্তিতে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকমের শস্য উৎপাদন হয়। এজন্য কোনাে কোনাে অঞ্চলে এক বা একাধিক বিশেষ বিশেষ শস্যের কেন্দ্রীভবন লক্ষ করা যায় । যেমন, পশ্চিম ভারতে তুলা কিংবা নিম্ন গাঙ্গেয় সমভূমিতে ধান, পাট; উত্তর ভারতে গম বিশেষ উল্লেখযােগ্য । এর অর্থ হল বেশি পরিমাণ কৃষি জমি ওইসব বিশেষ শস্যের জন্য ব্যবহার করা হয় । অন্যদিকে, এসব শস্যের পাশাপাশি কম পরিমাণ জমিতে অন্যান্য অনেক শস্য উৎপাদন করা হয়। সামগ্রিকভাবে কোনাে অঞ্চলে কোনাে এক বছরে এভাবে এক বা একাধিক শস্যের সমাবেশ ঘটে। তবে প্রতিটি শস্যের জন্য কর্ষিত জমির শতকরা অংশ সমান হয় না। 

সংজ্ঞা : - কোনাে অঞ্চলের মােট কর্ষিত জমির (Gross Cropped Area) সাপেক্ষে বিভিন্ন শস্যের শতকরা অংশ অনুযায়ী যখন শস্যগুলিকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে এক কিংবা একাধিক দলে সন্নিবেশ করা হয় অর্থাৎ যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তখন তাকে শস্য সমন্বয় বলে। 


শস্য সমন্বয়ের গুরুত্ব বা প্রয়ােজনীয়তা : -  

১) শস্য সমন্বয়ের ভিত্তিতে কোনাে দেশকে বিভিন্ন কৃষি বলয়ে বা অঞ্চলে ভাগ করা যায়, যাকে বলা হয় শস্য সমন্বয় অঞ্চল। শস্যের এভাবে আঞ্চলিকীকরণ কৃষি ভূগােলের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। 

২) এ ধরনের আঞ্চলিকীকরণ মানচিত্র দেখে কৃষির ভবিষ্যৎ রূপরেখা ও উন্নয়ন সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায়।

৩) বিভিন্ন শস্যের অখণ্ড সমাবেশের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। 

৪) একটি কৃষি-জলবায়ু অঞ্চলের (Agroclimatic region) কৃষি চিত্র (Agricultural mosaic) সম্বন্ধে যথাযথ ও পরিষ্কার ধারণা অর্জন করা যায়।  

৫) শস্যের দৈশিক আধিপত্যের ক্রম অনুসারে জমি ব্যবহারের স্বরূপ ও গুণাগুণ বিশ্লেষণ সম্ভব।

৬) শস্য সমন্বয়ের মাধ্যমে আধিপত্যযুক্ত শস্য তথা চাষ-আবাদের গতি-প্রকৃতি বিষয়ক আলােচনার ক্ষেত্র তৈরি হয়।

৭) কোনাে অঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। 

৮) অঞ্চলটিতে কৃষিকাজে ভূমির ব্যবহারের ধরন সম্পর্কে জানা যায়।


ভারতের শস্য-সমন্বয় অঞ্চল : - উইভার এর পদ্ধতিতে 2003-2006 সালে ভারতকে জেলাভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে 4টি শস্য সমন্বয় অঞলে ভাগ করা হয়। তাতে যে ফসলগুলি রয়েছে তা হল— ধান, গম, ভুট্টা, মিলেট, যব, ডাল, তৈলবীজ, তুলা ও আখ।

(1) এক ফসলি অঞল : অসম, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, ছত্তিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, কেরালা ও মহারাষ্ট্রের উপকূল অঞ্চলে একফসলি ধানচাষ প্রচলিত। আর রাজস্থান ও গুজরাটে একফসলি বাজরা চাষ প্রচলিত।

(2) দো-ফসলি অঞ্চল :পাঞ্জাব ও হরিয়ানাতে দো-ফসলি ধান ও গম চাষ হয়। সমগ্ৰ উপদ্বীপ অঞলে দো-ফসলি জোয়ার ও কার্পাস চাষ হয়।

(3) তিনফসলি অঞ্চল :তিনফসলি অঞ্চলগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল- (i) হিমাচল প্রদেশের ধান, গম ও ভুট্টা, (ii) পশ্চিম উত্তর প্রদেশের ধান, গম ও আখ, (iii) উত্তর-পশ্চিম রাজস্থানের বাজরা, তৈলবীজ ও ভুট্টা, (iv) দক্ষিণ-পশ্চিম রাজস্থানের ভুট্টা, বাজরা ও ডাল ইত্যাদি। এছাড়াও আরও পাঁচটি শস্য সমন্বয় অঞ্চল রয়েছে।

Post a Comment

0 Comments